Poem

শুভবাদী দিগন্তের দিকে

শামসুর রাহমান

এখানে তো অনেক বছর আমি কাটিয়ে দিলাম,
অনেক বছর দম-আটকানো পরিবেশে; পথ
চলতে খেয়েছি শুধু কর্কশ ঠোকর, পা দুটোয়
রক্তচিহ্ন সারা গায়ে যন্ত্রণার দাঁতের জহর
নিয়ে সেই কবে থেকে এক ফোঁটা ঘুমোতে পারি না
সারা রাত। দেয়ালে কীসব হিজিবিজি
অক্ষরের বুনো মাতলামি ফুটে ওঠে, কয়েকটি
অস্পষ্ট বেয়াড়া মূর্তি বিভীষিকাময়
নাচ জুড়ে দেয় আর হঠাৎ কখনও
দেয়ালের ডান দিকে কারা লোভাতুর
বিকটি মুদ্রায় নীল, লাল, সবুজ, খয়েরি আর হলুদ পাখির
মুণ্ডু ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিব্যি হাপুস হুপুস খেতে থাকে।
অনেক বছর ধরে এখানে বসত করে এই
মাটি এই গাছপালাকেই একান্ত আপন
বলে জানতাম। এর ফুল, এর ফল
এবং সোনালি ফসলকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি বারবার
আর কী তন্ময় হয়ে শুয়েছি পাখির গান, পাল-তোলা নায়ে
বসে কিয়দ্দূর থেকে দেখেছি রূপালি চর। দীপ
জ্বেলে অন্ধকারে কত পথভ্রষ্ট পথিককে দেখিয়েছি দিশা,
প্রতিদানে চাইনি কিছুই
কোনওদিন, কেবল চেয়েছি কিছু আলো জ্বালাবার অধিকার।

ডান দিক থেকে ওরা নানা ছদ্মবেশে এসে আমার হাতের
দীপ কেড়ে নিতে চায়, পুরাতন ঘায়ের পট্রির
মতো অতীতকে ব্যবহার করে বর্তমানকেও
ঘেয়ো নুলো বানিয়ে রাখার
জবর খায়েশে ওর পথঘাটে ঘন ঘন বাজার সাজায়
জেল্লাদার ভঙ্গিমায়। সেই সব দাঁতালের দাঁত
নখেরে চেয়েও ঢের বেশি ধারালো, বিষাক্ত আর জাঁহাবাজ
অস্ত্রের রোমশ ধমকের কাছে বড় অসহায় আজ জ্ঞান।
ডান দিক থেকে তেড়ে আসা সন্ত্রাসের জয়োল্লাস
আমাকে নিষিদ্ধ করে শহরে ও শহরতলীতে, চুপচাপ
সয়ে যেতে হয় কুবাক্যের ঝড়ঝাপ্টা, হম্বি-তম্বি। এই প্রিয়
সোঁদা মাটি কামড়ে থাকতে হবে আরও কিছুকাল। মনে হয়,
সত্তর বছর ধরে স্বদেশেই নির্বাসনে আছি। অমাবস্যা
কেটে গিয়ে মানবিক পূর্ণিমায় দিকগুলি নেয়ে
উঠবে কখন, তার প্রতীক্ষায় শুভবাদী দিগন্তের দিকে
গভীর তাকিয়ে থাকি হাতে নিয়ে কবিতার মালা।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 82

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts