Poem

সগীর বাউল এবং একটি পোড়ো জমির কথা

শামসুর রাহমান

গভীর রাতে পোড়ো জমির কিনারায় বসে দোতারা বাজিয়ে আপন মনে
আশ্চর্য তন্মায়তায়
গান গাইছিলেন সগীর বাউল। হঠাৎ কী যে হলো, তার তন্মায়তাকে ছিন্ন
করে জেগে ওঠে
একটি দৃশ্য, যা তার সুরের তাল লয় সবকিছুকেই থমকে দেয়। তার
হাতের দোতারা
শিউরে ওঠে। পোড়ো জমির বুক ফুঁড়ে বের হতে থাকে অনেকগুলো
মাথার খুলি,
ভাঙাচোরা কঙ্কাল। মাথার খুলিগুলির কদর্মাক্ত ওষ্ঠে থেকে নিঃসৃত হয়
একের পর এক
অনেক কথা। সেসব কথা শুনে সগীর বাউল বারবার কেঁপে উঠছিলেন,
বেদনার্ত হয়ে
উঠছিলেন বিবরণের করুণ ভয়াবহতায়। মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে যায় নিজের
কাছেই হাতেই
দোতারা, সঙ্গীতের তরঙ্গমালা। যেন তিনি এক পাথরের মূর্তি।

কিছুক্ষণ পর পোড়ো জমির মাথার খুলিসমূহ, ভাঙাচোরা কঙ্কালগুলি যেন
হাওয়ায় মিলিয়ে
যায়। পরদিন ভোরবেলা সগীর বাউল কিয়দ্দূরবর্তী এলাকার প্রধান
ব্যক্তিদের কাছে গত
রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তার বিবরণ কেউ কেউ বিশ্বাস করল, কেউ
কেউ
বাউলের মাথা বিগড়ে গেছে ভেবে প্রচুর হাসাহাসি কতল। দমলেন না
সগীর বাউল।
তাদের সেই দৃশ্য দেখাতে না পারলে বিরান হয়ে যাবে তার সুরেলা কণ্ঠ
সেই জমিনের
মতো, উন্মাদ হয়ে যাবেন তিনি।

সগীর বাউল এবং দূরবর্তী এলাকার তার অনুগামীরা পৌষ রাত্তিরে সেই
পোড়ো জমির
কাছে পৌঁছেতেই মরা জ্যোৎস্না নেমে আসে চারদিকে থেকে। জমি ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসে
অনেক করোটি, ভাঙাচোরা কঙ্কাল। দূরবর্তী এলাকার লোকজন ভয়ার্ত
মূর্তি যেন। পোড়ো
জমির জাগ্রত করোটিসমূহ এবং কঙ্কালগুলি বহু মানব-মানবীর নিখুঁত
আকার ধারণ করে।
তাদের পাশে ঘনিষ্ঠ দাঁড়ানো অনেক শিশু-কিশোর। সেসব মানব-মানবীর
অনেকেই
যুবক-যুবতী, কিছু প্রৌঢ়, ক’জন বুড়োসুড়ো লোক এবং মধ্যবয়সী নারী।
অনেকেই
ধর্ষিইতা। পোড়ো জমির ভেতর থেকে উঠে আসা নরনারী বজ্রের আওয়াজ
ধার করে
একসঙ্গে উচ্চারণ করে-‘একাত্তরের নরঘাতকদের শিকার আমরা।
দখলদার,যুদ্ধবাজ

সেনারা এবং তাদের তাঁবেদার দালাল, রাজাকার, আলবদরেরা পৈশাচিক
নির্যাতন চালিয়ে
আমাদের হত্যা করেছে। সেই সব যুদ্ধপরাধী আর ওদের সহযোগী
নরপশুদের বিচার
চাই। ওদের বিচার না হলে, ওদের পাশবিক নির্যাতনের শাস্তি না হলে
একদিন সারা
বাংলাদেশ পোড়ো জমিনে রূপান্তরিত হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই,
বিচার চাই।

পৌষ-রাত্রির মরা জ্যোৎস্নায় মানব-মানবীর কণ্ঠে বজ্রপাততুল্য শব্দাবলী
সগীর বাউল এবং
দূরবর্তী এলাকার আগন্তুকদের বিস্ময় বিহ্বল, ভয়াবহভাবে প্রশ্নাতুর,
প্রত্যয় দৃঢ় করে
তোলে। নিমেষে পোড়ো জমিতে অনেক করোটি, ভাঙাচোরা কঙ্কালের
কোলাহল।
অনন্তর থমথমে নীরবতা, পোড়ো জমির বুক জুড়ে অদ্ভুত চাঁদিনীর খাঁ খাঁ!

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 105

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts