Poem

স্মৃতিময় উজ্জ্বল আঁধারে

শামসুর রাহমান

খারাপ লাগছে এই নিস্তরঙ্গ সতেজ সকালে।
গুচ্ছ-গুচ্ছ পাতার আড়ালে
ফুল ফুটে আছে, পাখি সুন্দরের পাশে
বসে গান হয়, শৈশবের মতো কিছু মেঘ ভাসে
স্বরণমন্থনকারী আসমানে, অথচ আমার
খারাপ লাগছে খুব। যেন হৃদয়ের ঝোপঝাড়
ভীষণ বিশীর্থ আর জোনাকিবিহীন। আপতত
মুখ ধুতে রুক্ষ গালে ঘষতে বুরুশ কিংবা সুদীর্ঘ বিগত
রাত্রির জামাটা বদলাতে লাগছে না ভালো
কিছুতেই; মগজের রাশি রাশি কালো
আমাকে রেখেছে ঘিরে আপাদমস্তক, মনে হয়
ক্রমাগত যাচ্ছি ডুবে দীর্ঘ কৃষ্ণকায় ঘাসে; ভয়, তাই ভয়।

কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে পট। শত-শত কুশীলব
নব্য নায়কের করে স্তব
বেজায় পুরোনো সুরে, হয় নতজানু সারি সারি
পুরুষ ও নারী
ইস্পাতি নির্দেশে, মাঝে-মাঝে ওরা কী যেন কুড়ায়
ডানে-বামে, অকস্মাৎ যখন ফুরায়
মেকী সে উৎসব, জিভে তীব্র তেতো স্বাদ ঝুলে থাকে
সরাক্ষণ, ভাঙা দঙ্গলের ভেতরে কে কাকে ডাকে,
বোঝা দায়, এলোমেলো প্রেতারিত পদধ্বনি বাজে
চতুষ্পার্শ্বে, রুক্ষ শব্দরাশি মেশে আরো বেশি কর্কশ আওয়াজ।

খারাপ লাগছে এই নিস্তরঙ্গ সতেজ সকালে।
কী যে হয় চোখে পড়ে দূরে শুকনো ডালে
ঝুলছে তোমার জামা, যেন এক খণ্ড মেঘ, আবার হঠাৎ
প্রজাপতি হয়ে ওড়ে, ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে, শূন্য হাত
জামার ভেতরে কেলিপরায়ণ। আমার কাঁধের বারান্দায়
কে এক রঙিন পোস্টম্যান ভাসমান, ডেকে যায়
প্রহরে প্রহরে কখনও-বা পল্লবের ভিড় থেকে
সহসা বেরিয়ে আসে হলদে মসলিনে মুখ ঢেকে,
অথচ জরুরি খাম, টেলিগ্রাম, কিছুই করে না বিলি, শুধু
নাচায় বাদামি ব্যাগ ধু ধু
দিগন্তের দিকে আর একজন দলছুট অন্ধ কবি জীর্ণ রাজবেশে
চলে নিরুদ্দেশে।
আমিও বেরিয়ে পড়ি মাঝে-মাঝে চোখ-কান বুজে
মায়াবী চপ্‌পল পায়ে, খুঁজে
বেড়াই তোমাকে রাত্রিদিন তুমিহীন
এ শহরে, কবেকার টেলিফোন পোল, ডাকবাক্স ম্যান্ডোলিন
সময়ে মলিন হতে থাকে আর ঘরে ফেরা মানে
নিজের কাছেই ফিরে-আসা জেনে অন্তর্গত টানে
বারংবার চলে আসি স্মৃতিময় উজ্জ্বল আঁধারে একা একা,
বিরূপ হাওয়ায় লুপ্তপ্রায় পদরেখা।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 150

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts