Poem

তবে কি বাতিল, পরিত্যক্ত?

শামসুর রাহমান

হানাবাড়ি নয় কিংবা উৎকট ওষুধগন্ধী মর্গও নয় কোনও
তবু কেন লাশকাটা ঘরের আদল ফুটে ওঠে? শ্যামলীতে
আমার আপন ছোট ঘরও এটি নয়, তবু কেন
আমার মতোই কেউ এই মেঘাচ্ছন্ন গৃহকোণে
মেঘের শয্যায় শুয়ে আছে প্রায় নিথর নিষ্প্রাণ?
দু’চোখের পাতা বোজা মাঝে মাঝে কাঁপে শুকনো ঠোঁট।

তবে কি বাতিল, পরিত্যক্ত এ লোকটা, মানে আমি?
কী আমার অপরাধ? এই তো যে ফেরেশ্‌তার আধিপত্যছুট
সুর আমি মানুষের কণ্ঠে
দৈব কণ্ঠস্বর নিয়ে আমার অক্লান্ত সাধনায়
বড় বেশি মেতে উঠেছিলাম যৌবনে, এমন কী প্রৌঢ়ত্বের
প্রখর প্রহরে। দুর্বিনীত আকাঙ্ঘা আমার বুঝি
সবুজ চোখের ঈর্ষাপরায়ণ ফেরেশ্‌তাকে খুব অপ্রসন্ন
করেছে বলেই আমি কণ্ঠস্বর প্রায় হারিয়ে নিঃশব্দ, রুক্ষ
কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। যতই জাগাতে চাই
কণ্ঠস্বর, কণ্ঠনালী তুষারের অজস্র কণায় ঢেকে যায়।

কী নিঃসাড়, নির্বাসিত মনে হয় ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে আমার।
এমন দুঃসহ একা কখনও লাগেনি আগে, যেন
কেউ নেই, অদূরে অস্পষ্ট কয়েকটি ছায়া নড়ে চড়ে না কি?
চোখ খুলি, চোখ বুজি, কবিতার পঙ্‌ক্তি
স্মরণে আনতে চাই। সব হিজিবিজি
মনে হয়। দ্বিপ্রহরে বিশ্রাম হেলায় ফেলে, বুকের শোণিত
পানি করে
অগণিত রাত্রিকে বানিয়ে ভোর লিখেছি কত না পদাবলী,
অথচ এখন এই ঘোর তমসায় কেউ আসছে না আমার নিকট,
দিচ্ছে না বুলিয়ে হাত কপালে অথবা অনুরাগে
আমার তৃষিত ওষ্ঠে চেপে ধরছে না ঠোঁট, শুধু
দূরে অন্ধকার গায়ে মেখে উড়ে উড়ে চলে যায়
সম্ভবত ঈর্ষান্বিত ফেরেশ্‌তার ভয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় আমার
অবসন্ন, মুমূর্ষ দুর্দশা দেখে। মনে হয়, শুধু
আমার প্রথমা কন্যা আর তার কর্মিষ্ঠ জীবনসঙ্গী ঝুঁকে
আছে এই শীর্ণ, প্রায় নিশ্চেতন অস্তিত্বের দিকে অসহায়
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে। দূর থেকে ক’জন ফেরেশ্‌তা, যারা দৈব
কণ্ঠস্বর হয়ে স্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলে বাতিল চিঠির মতো, অট্রহাসি
আমার সকল কাব্যগ্রন্থকে পাঠায় নিরুদ্দেশে?

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 106

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts