Poem

আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব

শঙ্খ ঘোষ

বৈশম্পায়ন বললেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভের ছত্রিশ বছর কেটে গেলে বৃষ্ণিবংশে ঘোরতর দুর্নীতি দেখা দিল। সেই দুর্নীতিপ্রভাবে যাদবেরা একদিন পরস্পর পরস্পরের বিনাশসাধন করলেন। মৌষলপর্ব, মহাভারত।

আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব

সময় ছিল হলুদজল, গন্ধ বুনো বল্লীদের
আবহমান মাটির
সাগরপার আর পাহাড়তলির ছড়ানো এই মিলনকোণ
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব।

কালপুরুষ ঘুরে বেড়ায় গোপন পায়ে ঘরে ঘরে
উপড়ে নেয় মগজ
ইঁদুর ঘোরে উল্কা খসে পলক ফেলতে কবন্ধ
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব

সবাই সবার পাশ দিয়ে যাই কেউ কাউকে দেখতে পাই না
পাখির ঝাঁকও ডাইনে বেঁকে ওড়ে
বৃষ্টি নেই, সূর্য চাঁদ ধূসর লাল শামলা রং
বৃত্ত করে ঘোরায় নিজের পাশে

গরুই আজ গাধার মা, হাতির বাচ্চা খচ্চরের
বেজির পেটে ইঁদুর
সারস ডাকে পেঁচার মতো, ছাগলদের শেয়ালডাক
ঘরের বুকে রক্তপায়ে পাণ্ডুরং কপোত

ডালপালার কোটর ভেঙে একে একে বেরিয়ে আসে
সাত্যকি আর কৃতবর্মার দল
পায়ের ক্ষুরে জয়ধ্বনি আঙুলচুড়োয় জয়ধ্বনি
আমাদের এই তীর্থে ঘোর উৎসব

হঠাৎ সবাই তাকিয়ে দেখি নিজের নিজের হাতের দিকে
সবুজ ঘাস? ভল্ল? না কি মুষল?
লাফ দিয়েছে হরিণ, তার চমক সোনায় ঝলসে ওঠে
শেষ বিকেলের বোঝাপড়ার দিকে

আমরা যাদব আমরা, বৃষ্ণি আমরা অন্ধক
ঘোর তীর্থে আজ আমাদের খেলা
হৃদয়ভানে এগোই আর কণ্ঠনালী আঁকড়ে ধরি
সূর্য যখন গড়ায় জলের নীচে

সবাই সবার চোখে ঘাতক, দেখি লুব্ধ লালা
নিজের নিজের সত্য বানাই নিজে
পাতা ঝরছে মাথার ওপর শিশিরজলে পাপ পোয় না
চারদিকে ঢেউ, ফসফরাসের আলো

যাদব, আমরা বৃষ্ণি কিংবা অন্ধক
সাত্যকি বা কৃতবর্মার দল
মদ আমাদের আত্মঘাতের ভবিতব্য, বারণ ছিল
এ উৎসবে সবাই আজ মাতাল

জয়ধ্বনি তোলে নিশান আমার নিশান তোমার নিশান
ভল্ল? না কি মুষল? না কি ঘাস?
আমাদের এই পায়ের নীচে ভিন্ন সব জলস্রোত
তাপ্তী আর কৃষ্ণা আর গঙ্গা

এই সে লোক প্রাণ নিয়েছে ছিন্নবাহু ভূরিশ্রবার
খড়ের চালে হঠাৎ লাগায় ফুলকি
ইমানহীন ক্লীব আর সুড়ঙ্গময় গুপ্তঘাতী
এই সে লোক ওই সে লোক এই সে

মনে কি নেই ঘুমের মধ্যে কিশোরদের হত্যা
বিস্ফোরণ, হাত-পা বাঁধা চুরমার
সবুজ ঘাস হলুদ ঘাস তীক্ষ্ণ ঘাস শরবনের
এবার সব ফিরিয়ে দেবার সময়

পুবের থেকে পশ্চিমে চাই, ভাঙছে অলীক উলটো খাঁচা
আমাদের এই তীর্থে এমন উৎসব
ত্রয়োদশীয় অমাবস্যা, চোখের মধ্যে বেঁধে বর্শা
লাফিয়ে ওঠে হৃৎপিণ্ডের আগুন

ছিটকে আসে হরিণ, তার মুক্তি নেই উদ্‌গতির
শরীর থেকে ছিঁড়ছে সব সুঘ্রাণ
কৃতবর্মার মাথায় ওই খড়্গ তোলে সাত্যকি
যাদব নেই, বৃষ্ণি ভোজ অন্ধক

আমরা আর যাদব নই, অন্ধক বা ভোজ
শৈনেয় বা বৃষ্ণি আমরা আজ
যাজকদের আগুনে আজ লাল নীল সবুজ শিখা
খুঁজে বেড়ায় ঝলসে নেবার হরিণ

সত্যকে আজ ঘুরিয়ে নিলেই এক লহমায় মিথ্যে, আর
মিথ্যেকেই বানিয়ে নিই সত্য
পাতায় পাতায় খুঁজে বেড়াই কে আমাদের শত্রু, যেন
কারোই কোনো বন্ধু নেই কোথাও

আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব
আমাদের এই তীর্থে শেষ উৎসব
আত্মঘাতের শবের ওপর উঠে আসছে লবণজল
সাগরজলে ভাসে আমার বংশ

চোখের সামনে সাত্যকি আর প্রদ্যুম্নের বিনাশ
মনে পড়ে গান্ধারীশাপ শাম্বরঙ্গ ছল
অমোঘ নিয়ম ফলতে থাকে, ধুইয়ে দেয় অতীতভার
আমরা এগোই জলস্রোতও এগোয়

এই আমাদের শবের ওপর মিলছে এসে জলস্রোত
তাপ্তী আর শতদ্রু বা গঙ্গার
পুবপশ্চিম ভাঙতে ভাঙতে ছুটে যাচ্ছে হস্তিনাপুর
আমরা এগোই জলস্রোতও এগোয়

যেদিকে চাই প্লাবনজল, ঘোড়াও যেন মাছের মতো
রথগুলি-বা ভেলা
পথ আবর্ত, ঘরগুলি হ্রদ, শেওলা যত রত্নরাশি
যেদিকে চাই যেদিকে চাই সাঁতরে যায় কুমির

ডুবুক সব শস্ত্র রথ, ধুয়ে ফেলুক সাগরজল
আমাদের এই প্রভাস যাক থেমে
ছুটছে কোন অভিষেকের অঘোর জল অতল জল
সবল জল হস্তিনাপুর মুখে

হরিণ তার রক্তরেখা মিলিয়ে দেয় শতদ্রুতে
ব্রহ্মপুত্রে ছড়িয়ে রাখে অজিন
মুখোশ ঝোলে মধ্যদেশে শিঙের বাহার জ্যোৎস্নাময়ী
গন্ধ কেবল উড়ছে দেশজোড়া

আমাদের এই তীর্থে আজ ভেঙে পড়ার উৎসব
তাকিয়ে আছে হাজার মাঠ গহ্বর
বিনাশ তার আনন্দের উৎসারের প্রতীক্ষায়
ঝলসে ওঠে আকাশমুখী চিমনি

আমাদের এই তীর্থজল মাঠ খামার গহ্বরের
আমাদের এই তীর্থে শেষ উৎসব
ধ্বংস আর বিশ্বাসের, বিনষ্টি আর সৃষ্টিমুখ
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব

আমাদের এই তীর্থে ঘোর উৎসব
আমাদের এই তীর্থে শেষ উৎসব

Author Bio

শঙ্খ ঘোষ, ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতের একজন শক্তিমান বাঙালি কবি ও সাহিত্য-সমালোচক। তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন কাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশের উত্তরসূরী। তার

More

This post views is 739

Post Topics

Total Posts

260 Published Posts