Poem

ওভার ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে একজন মানুষ। এটা
ওর দোতলা বাড়ির ছাদের স্বপ্ন।
*
ফুটপাথের যে বাচ্চাটা নর্দমায় হাত ড়ুবিয়ে খলবল করছে
ওকে কি সাধ করে আনা হয়েছে এই অনিশ্চিত জীবনে?
দু’জন নারী পুরুষের রমণের সুখ থেকেই তো ওর জন্ম
অথবা সুখ ছিল না, সুখের বোধ ছিল না
কিংবা সেই দু’জন হয়তো চুম্বনের স্বাদও জানে না
চুম্বনহীন সঙ্গম কিংবা জীবনচর্যাও মানুষের পক্ষে সম্ভব?
*
ইংলিশ বাজারে মাছ বিক্রি করতে আসে গৌরাঙ্গ সুলেমান
আসলে সে কখনও সুলেমান, কখনও গৌরাঙ্গ, একই অঙ্গে দু’জন
গৌরাঙ্গ খুব পোস্ত খেতে ভালোবাসে, সাত বছর খায়নি
সুলেমান ভালোবাসে প্রকাশ্যে কুঁচকি চুলকোতে,
সেটা সম্ভব নয়
বছরের পর বছর অবদমন, তাই থুতু ফেলে যখন তখন!
*
পরেশবাবুদের বিড়ালীটির পায়ে কে আলতা পরিয়ে দিয়েছে
হাতচাপুড়ি দিলে সে দু পা তুলে নাচে
মাঝরাতে সে পাঁচিলের ওপর উঠে পিঠ বাঁকায়
চোখ দুটি জ্বলন্ত অঙ্গার
চাঁদ ধরার জন্য সে লাফ দেয় আকাশের দিকে
খানিকবাদে তার মুখে মাখামাখি টাটকা রক্ত।
*
ফ্ল্যাটবাড়ির কাজের মেয়েটি, সতেরো, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে
যে-যে কারণে এ রকম হয়, তার কোনওটাই তো মেলানো
যাচ্ছে না
ওখানে কোনও পুরুষ মানুষই নেই, দুটি বিধবা
ও এক চিরকুমারীর সংসার
কেউ ওকে চড়-চাপড় মারে না, খুব বেশি চোপাও করে না
সবাই আতপ চালের ভাত খায়, মাছের টুকরোও প্রায়
সমান সমান
সন্ধেবেলা পাড়া বেড়ানোতে কোনও বাধা নেই
তবু তুই মরতে গেলি কেন রে মেয়ে?
ঝুলন্ত লাশের উত্তর: বাঃ, গরিব মানুষদের বুঝি অকারণে
মন খারাপ হতে পারে না?
*
একটা নদী যখনই অন্য একটা নদীতে এসে মেশে
অমনি একটু দূরে আর একটা নদী বাইরে বেরিয়ে যায়
ওদিক থেকে আসা নদীটির গতর দিন দিন শুকোয়
অন্য নদীটি পাড় ভেঙে ভেঙে খেয়ে দিব্যি ফুর্তিতে আছে
মূল নদীটি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে জ্যোৎস্নারাতে
প্রথম জোয়ারের মৃদু কুলকুলু ধ্বনিতে সে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে
ফিরে-আসা নদীটিকে সে বুকে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
কী রে, তোর বুঝি সমুদ্র পছন্দ হল না
দু’জনে যখন নির্লজ্জতায় মেতে উঠে
প্রায়-শুকনো নদীটি তখন চেয়ে থাকে ভ্রাম্যমাণ মেঘের দিকে
তার দীর্ঘশ্বাসে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে
মেঘের ওপরে এক দেবতা!
*
এ এক যুগ এসেছে, কাপুরুষরাই শুধু যুদ্ধের দামামা বাজায়
ওই দামামাগুলো যারা বানায়, তারা সবাই জন্মান্ধ
বিনিময়ে তাদের জন্য আসে প্রচুর গিল্টি করা আয়না
সেই আয়নায় ঠোক্কর খায় মৌমাছি আর চড়াই পাখি
মধুলোভীরা হা হা শব্দ করে ভোট বাক্সে, আর উজানে যায় নদী
তার ওপরে সেতুটি নড়বড় করছে, কারুর হুঁশ নেই, ছুটে আসছে ট্রেন
দু’দিকের রাস্তা বিস্তারিত হতে হতে খেয়ে নিচ্ছে ফসলের ক্ষেত
আর সেই সব ফসল উনুন খুঁজতে চলে যাচ্ছে নিরুদ্দেশে
এদিকে কত যে উনুন খালি পড়ে আছে, আগুন নেই, শুধু ছাই
সারা গায়ে ছাই মেখে গাজনের সঙ বেরিয়েছে, দর্শক নেই একটিও
কোথাও চলেছে হরির লুট, তার বাতাসাগুলো টপাটপ খেয়ে নিচ্ছে
স্বয়ং শ্রীহরি
এ ভাবেই গল্পের গোরু গাছে ওঠে আর কবিতার নটে গাছটি মুড়োয়…

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 217

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts