Poem

যেমন স্বপ্নের মধ্যে তীব্র নীলাকাশ
সময়ের মধ্যে এক সময়হীনতা
যেমন দৃষ্টির মধ্যে দৃশ্য, কিংবা দৃশ্যেরও জন্মের
অন্তরালে চিরন্তন যেমন অমোঘ রহস্যের স্থির রস
মুখোমুখি সৃষ্টি ও পাতাল পরস্পর মুখ দেখে যেমন কৌতুকে
যেমন নিজেরই রক্ত থ্যাঁতলানো মশার পেটে দেখে ঘৃণা হয়
আমি ঠিক সেই রকম এক অনিবার্যতায় পঁচিশ বছরে
ভিজে ঘাসে মুখ ঢেকে শুয়ে আছি পঁচিশ বছরে
কিছু চুরি করা রত্ন নিপুণ গোপন করে পঁচিশ বছরে
স্বপ্নে লোভে বিপরীত তৃপ্তিতে ঘৃণায় শুয়ে আছি
সময়ের মধ্যে এক সময়হীনতা হাতে নিয়ে।
স্মৃতির অঙ্গার মেখে কে যায় ও গহন সন্ন্যাসী?
মেঘদল ক্ষণে ক্ষণে মত্ত হয় নীলিমা আহারে;
এবৎসর কোনো ঋতুভেদ নেই, আজ মনে হয়
বাতাস এ বৎসর দিক বদলাবে না
শতাব্দীর গ্রীবা মুচড়ে ধরেছে কে নির্লিপ্ত-নিষ্ঠুর?
এ বৎসর মৌমাছিরা পান করবে শিশিরের জল।

ঘাসের ছায়ায় একটি পিঁপড়ে শুয়ে আছে
দলছাড়া, গতিহীন, এমন নির্জন পিঁপড়ে এর আগে কখনও দেখিনি
রোদ্দুরে অপরিচ্ছন্ন চোখেমুখে বিপুলা পৃথিবী ঘুরে আসি বহুবার
সব দিকে অস্পষ্টতা, আলজিরিয়া, লেবানন, ভারতের কনিষ্ঠ প্রদেশে
সব দিকে অস্পষ্টতা, লুকানো ছুরির ফলা, অস্থির বিশ্বাস, আমি
ঘুরে ঘুরে দেখি,
ঘাসের ডগার নীচে যে বিশুদ্ধ ছায়া
সেখানে শয়ান এই নির্জন পিঁপড়ের মতো আর দৃশ্য নেই।
অনেক বসন্ত ঋতু সমুদ্রের গর্ভের ভিতর
মৃত প্রবালের স্তূপ সাজিয়ে রেখেছে
আমিও রক্তের মধ্যে অনেক তরঙ্গ, প্রেম, সমুদ্র বিস্তার
গেঁথেছি, তবুও আজ কোনো মায়াদ্বীপ—আমার সম্মুখে নেই..
মায়াদ্বীপ নেই, বিধৃত যৌবনে কোনো মায়াদ্বীপ নেই,
এই কথা ভেবে আমি পৃথিবীর জ্যেষ্ঠতম ভয়ে
চাপা, আর্ত শব্দ করে বহুবার ছুটে গেছি কোনো এক পাখির কাছে
জানুতে লুকিয়ে মুখ, ওষ্ঠ চেপে অরুণ যোনিতে দু
রন্ত পশুর মতো অজ্ঞাত বোধের স্পর্শে কেঁপে
আত্মার আগম পথে অস্ফুটে বলেছি
চলো মায়াদ্বীপে যাই, একবার মায়াদ্বীপে, চলো
এখনি দুজনে যাই, স্বপ্নের কৃতার্থে যাই, মায়াদ্বীপে, মায়া…

–জানি, একে পলায়নবাদ বলে, যুবাদের বড় প্রিয় পেশা,
এই কথা বলে সেই রমণীটি আমাকে সম্মুখে তুলে ধরে
তৎক্ষণাৎ দুই চক্ষে হলুদ রুমাল বেঁধে দেয়
আমি তার রূপ দেখি, বিদ্যুল্লেখার মতো রূপ—
আকাশ অদ্ভুত বর্ণ, একটি হলুদ চিল ঘুরে ঘুরে ডাকে।
ভিজে ঘাসে মুখ ঢেকে আজ আমি শুয়ে আছি পঁচিশ বছরে,
পঁচিশ বছর তার অন্তঃস্থিত সময়হীনতা
নিরন্ত স্রোতের নীচে চিরকাল শান্ত নীল জলের মতন
অকস্মাৎ মেলে ধরে; সব কিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলেছে জেনে আমি
স্বপ্নে, লোভে, বিপরীত তৃপ্তিতে ঘৃণায় শুয়ে আছি,
মুষ্ঠিতে লুকিয়ে রেখে দুর্লভ শিল্পের পরমায়ু।

আমি কি শিল্পের জন্যে প্রাণ দেব? তবে তো শিল্পের বরতনু
কত পূর্বশহিদের রক্ত মেখে বীভৎস, নিষ্ঠুর!
বাণীর মন্দিরে পূজা দিতে এসে যূপকাষ্ঠ কে চায় সাজাতে
কোন মূর্খ অভিমানে, পিপাসায় ধর্না দিয়ে আছে?
কিটসের অমর মৃত্যু লেগে আছে সন্ধ্যার আকাশে।

সহসা বাতাস এসে দেবদারু বৃক্ষটির প্রত্যেকটি পাতায়
কিছু শিহরন রেখে গেল।
একটি আঁধার জাল এখনি আকাশ থেকে রাতচরা পাখিগুলি
সব নিয়ে যাবে।
আকাশ স্বপ্নের মতো তীব্র নীল এ-প্রদোষকালে।

এবার আমিও যাব, দেখা হবে সাতটা পঁচিশে
গাড়ি বারান্দার নীচে, প্রতীক্ষায় আছে সেই নিরবধি নারী
সুপ্ত পূর্বস্মৃতি খুলে শরীরে উত্তাপ এনে নেব
দেশ-কাল-শিল্পবোধ আমাদের কিছুদূর পৌঁছে দিয়ে যাবে
ঈশ্বর নৌকোর হাল হাতে নেবে নরকের খেয়াপার ঘাটে।

—তোমার কপালে কিছু ধুলো লেগে আছে, বলে মেয়েটি একবার
আঁচলের প্রান্ত দিয়ে আমার ললাট মুছে দেবে।

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 169

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts