Poem

মণিকর্ণিকার ঘাটে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মণিকর্ণিকার ঘাটে গাঁজা টানছে কয়েকটি সাধু। অ্যালেন, পিটার, মোহন, রাকেশ আর আমি যোগ দিয়েছি সেই অর্ধবৃত্তে। এখানে গঙ্গায় জোয়ার-ভাটা খেলে না, ফিনফিনে জ্যোৎস্নায় নদী যেন এক অচেনা দেশের স্বপ্নময় রাজপথ। কাছাকাছি চিতায় যে জ্বলছে, সে অর্ধ-দগ্ধ অবস্থায় আসা একটি তরুণী। কে যেন বলল, তার জীবনের চেয়ে তার মৃত্যুর এই আগুন বেশি সুখের।
অ্যালেন জিজ্ঞেস করল, আমরা কি আমেরিকা বা ভারতের মানুষ? না পৃথিবীর? অথবা মহাজাগতিক সন্তান?
আমি বললাম, যে মেয়েটি আমাদের সামনে পুড়ে যাচ্ছে, সে ভারত চেনেনি, আমেরিকা চেনেনি, পৃথিবীও চেনেনি, গ্রামের পাশে যে গম ক্ষেত, তার দিগন্তই ওর চোখের সীমানা। এই প্রথম তার ক্ষত-বিক্ষত শরীর এসেছে শহরে, চিতায় দগ্ধ হবার জন্য।
কয়েকবার গাঁজায় টান দেবার পর আমাদের মন বেশ যুক্তি ঝেটিয়ে ফেলে পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। আকাশ উন্মুক্ত, বাতাসে মাংস পোড়া গন্ধ সুগন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত বেসুরো ঘণ্টাধ্বনিগুলি সুরেলা হয়ে ওঠে। আমরা ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিক হতে থাকি ক্রমে। আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন অলডাস হাসলি আর টিমোথি লিয়ারি। কত বিশ্ব বিশ্বাসের কথা বলাবলি হয়।
চিতাটিতে মেয়েটির আলতা পরা দুটি পায়ের পাতা এখনো বেরিয়ে আছে বাইরে। অক্ষত, অনির্বচনীয়। কেউ কি ওকে মনে রাখবে? ওর কি একটা অর্ঘ্য প্রাপ্য নয়! ওর মুখ দেখিনি, তবু ওর মুখ আমি রচনা করি। আমি অ্যালেনকে বলি, এসো, ওর পায়ে আমরা চুম্বন দিই। সঙ্গে সঙ্গে মহাজাগতিক এই কজন গাঁজাখোর উঠে গিয়ে সেই চিতাটির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে।

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 167

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts