Poem

অন্য দেশের কবিতা: বিংশ শতাব্দী

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রথমেই জানিয়ে রাখতে চাই যে, এই বইতে যাঁরা বিশুদ্ধ কবিতার রস খুঁজতে যাবেন, তাদের নিরাশ হবার সম্ভাবনাই খুব বেশি। এ বইতে কবিতা নেই, আছে অনুবাদ কবিতা। অনুবাদ কবিতা একটা আলাদা জাত, ভুল প্রত্যাশা নিয়ে এর সম্মুখীন হওয়া বিপজ্জনক। অনুবাদ কবিতা সম্পর্কে নানা ব্যক্তির নানা মত আছে, আমি এতগুলি কবিতার অনুবাদক, তবু আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, অনুবাদ কবিতার পক্ষে কিছুতেই বিশুদ্ধ কবিতা হওয়া সম্ভব নয়, কখনও হয়নি। কোলরিজ বলেছিলেন, একটি কবিতার সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।–সেই বিশুদ্ধ ব্যাপারটি কী তা বুঝতে হলে, আর একটি বিশুদ্ধ কবিতা পড়ে দেখতে হবে, আজ পর্যন্ত কোনও সমালোচক তার বর্ণনা করতে পারেননি। কবিতার সংজ্ঞা, ব্রহ্মেরই মতন, অনুচ্ছিষ্ট। সংজ্ঞা না হোক, এই সরল সত্যটি সর্ববিদিত যে, কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য তার শব্দ ব্যবহার, বিংশ শতাব্দীর কবিতা সংগীতের প্রভাব কাটিয়ে শব্দের গভীর অর্থের প্রতিই বেশি মানোযোগী, এবং এক ভাষার শব্দ-চরিত্র অপর ভাষায় হুবহু প্রকাশ করা একেবারে অসম্ভব।

আর একটি স্বীকারোক্তি এই যে, আমি পাঁচটি প্রধান ইয়োরোপীয় ভাষার কবিতা এখানে উপস্থিত করেছি, কিন্তু এই ভাষাগুলির কোনওটিই আমি সম্যক অবগত নই। ইংরেজিতে নানান দ্বি-ভাষা সংস্করণ পাওয়া যায়, আমার প্রধান অবলম্বন সেইসব গ্রন্থাবলী, যেখানে তাও পাওয়া সম্ভব হয়নি, সেখানে শুধু ইংরেজির মাধ্যম থেকেই আহরণ করেছি, মূল ভাষা না জেনে অনুবাদ করার প্রচেষ্টা, গুরুতর ধৃষ্টতা বা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু এজন্য আমি নিজেকে তেমন অপরাধী হিসেবে মনে করি না, তার প্রথম ছোট কারণ, শব্দের সৌকুমার্য যখন ভাষান্তরিত করা অসম্ভব, তখন মূল ভাষা জানার প্রশ্ন জরুরি নয়; দ্বিতীয়ত, আমার আগে এই ধরনের অনুবাদের কাজ বাংলাদেশে করেছেন আরও অন্তত পঞ্চাশজন কবি, যাঁদের শিরোভাগে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বাংলাদেশে যারা বিদেশি ভাষায় পণ্ডিত তারা হয় কবিতার অনুবাদ করতে চান না, অথবা কবিতা অনুবাদ করার যোগ্যতা নেই তাদের। কিন্তু বিদেশের কবিতার সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের এইজন্যই পরিচিত হওয়া প্রয়োজন যে, তাতে সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা বুঝতে সুবিধে হবে এবং অহেতুক হীনমন্যতা বা অহংকার কেটে যাবে। সুতরাং, কবিরাই যতদূর সম্ভব প্রস্তুত হয়ে একাজ করছেন। তা ছাড়া, আমার বিশ্বাস, কবিতা পড়ে বোঝার মতন বিদেশিভাষার জ্ঞান খুব কম লোকের পক্ষেই আয়ত্ত করা সম্ভব, অনুবাদ করা তো দূরের কথা। যে-ইংরেজি ভাষার সঙ্গে আমরা আবাল্য পরিচিত, সেই ইংরেজি কবিতারও সম্পূর্ণ রস আমরা পাই কিনা, সে সম্পর্কে ঘোর সন্দেহ এখনও আমার রয়ে গেছে। সমালোচকের সমর্থন না পেয়ে, কোনও নবীন ইংরেজ কবিকে আমরা এখানে প্রশংসা করতে সাহস পাই না। অন্যদিকে বহু বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ কবিকেও কোনও অজ্ঞাত কারণে গোপনে খারাপ লাগে। অন্যভাষার কবিতার মূল কবিত্ব থেকে পাঠককে বঞ্চিত থাকতেই হয়, যেটুকু পাই, তা হল কবিতার ভিতরের গল্পটুকু, অর্থাৎ বর্ণিত বিষয়ের প্রতি কবির মনোভাব, তার চিন্তার ভঙ্গি, বাক্য গঠনের বৈশিষ্ট্য, নতুন ধরনের কলাকৌশল, সভ্যতা বা ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে তাঁর দর্শন। এইগুলি জানার জন্য, তিন বছর বা পাঁচ বছর শেখা জার্মান ভাষায় জার্মান কবিতা পড়ে যেটুকু উপকৃত হওয়া যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি উপকৃত হওয়া সম্ভব পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে শেখা ইংরেজি ভাষায় জার্মান কবিতা পড়ে। তারচেয়েও বেশি সুবিধাজনক, মাতৃভাষায় জার্মান কবিতার অনুবাদ পড়া। সুতরাং বিশুদ্ধ কবিতা আস্বাদনের তৃষ্ণা বিশুদ্ধ বাংলা কবিতাতেই নিবদ্ধ রেখে, কিংবা আপাতত ভুলে গিয়ে, উপরোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কেই শুধু যাঁরা কৌতূহলী হবেন, তাঁদের কাছে এই অনূদিত কবিতাবলী অকিঞ্চিৎকর হয়তো মনে হবে না।

কবিতার অনুবাদ গুণ সম্পর্কে আমি ঘোরতর অবিশ্বাসী হয়েও কেন এতগুলি কবিতার অনুবাদ করেছি—সে কারণও আমি জানাচ্ছি। শ্রদ্ধেয় সাগরময় ঘোষ দেশ পত্রিকার জন্য বিদেশি কবিতার অনুবাদ করতে আমায় অনুরোধ করেন। অনেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিরও মানুষ চিনতে দু-একবার ভুল হয়ে যায়, হয়তো সেইরকম কোনও ভুলের বশেই তিনি আমার মতো অযোগ্য ব্যক্তিকে এরকম গুরুতর কাজের জন্য বেছেছিলেন। তিনি না বললে, এরকম কোনও পরিকল্পনাই আমার ছিল না। কিন্তু আমি এ দায়িত্ব নিতে যে পরাজুখ হইনি, তার কারণ আগেই বলেছি, এ কাজটাকে আমি খুব গুরুতর মনে করি না। আমি নিজে যেমন অনুবাদ কবিতার কাছে বিশেষ কিছু দাবি করি না, যা দাবি করি, (উপরে উল্লেখ করা হয়েছে) তা আমার পক্ষেও পরিবেশন করা সম্ভবত শক্ত নয়। এখানে বিশেষ কোনও প্রতিভা বা মেধার প্রশ্ন নেই, প্রয়োজন শুধু পরিশ্রম। আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরা সাধারণত ইংরেজি কবিতাই পড়েন, কিন্তু সাম্প্রতিক পৃথিবীর সাহিত্যে সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যে ইংরেজি কবিতার স্থান অনেক নিচুতে। আলস্যবশে, কিংবা সুলভ নয় বলেই আধুনিক ফরাসি-জার্মান-ইতালিয়ান ইত্যাদি কবিতার অনুবাদ সাধারণ পাঠকদের চোখে পড়ে না। আমি সেইসব ভাষার আধুনিক কবিদের নির্বাচন করে, জীবনী সাজিয়ে, সাহিত্যে আন্দোলনগুলির পরিচয় জানিয়ে ধারাবাহিকভাবে কবিতার সচ্ছন্দ অনুবাদ প্রকাশ করছি মাত্র। আমার কৃতিত্ব শুধু পরিশ্রমের। আর কিছু না।

পত্রিকায় প্রকাশের সময়, একজন অচেনা তরুণ আমায় চিঠি লিখে কৈফিয়ত চেয়েছিলেন এই বলে যে, আমি আমেরিকা মহাদেশে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলুম বাংলা কবিতা অনুবাদ করার জন্য, সেখানে সে কাজ না করেই ফিরে এসেছি, অথচ দেশে ফিরেই অন্য দেশের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করতে শুরু করেছি কেন? উত্তর খুব সরল। আমি ইংরেজি জানি না, কিন্তু বাংলা ভাষা জানি। সাহিত্য পদবাচ্য হবার মতন ইংরেজি আমার পক্ষে ইহজীবনে লেখা সম্ভব নয়, ইংরেজি থেকে যেকোনও বিষয় আমার পক্ষে নির্ভুল বাংলায় প্রকাশ করা সম্ভব। এ কথাটা জানার জন্য আমার পক্ষে আমেরিকা পর্যন্ত যেতে হল কেন? যাবার সুযোগ পেলে কে না যায়? তা ছাড়া, বিদেশে গিয়েই স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলাম, অন্য ভাষায় লেখার চেষ্টা বা অনুবাদ করার চেষ্টার মধ্যে অত্যন্ত দীনতার ভাব প্রকাশ পায়, আমি এরকম চেষ্টা আর। কখনও করব না। ইংরেজি ভাষা আমাদের পক্ষে লাভজনক, কিন্তু সম্মানজনক নয়। পরভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টায় সার্থক হয়েছে পৃথিবীতে এরকম উদাহরণ এপর্যন্ত দু-তিনজন মাত্র, আমাদের ভারতবর্ষ থেকে এখনও একজনও না। শুভাচার বা অনাচার শুধু মাতৃভাষাতেই সম্ভব।

কবির কাছে তার কবিতার প্রতিটি শব্দই মূল্যবান ও অবধারিত। সেইজন্য কবিতার অনুবাদ আক্ষরিক হওয়াই অনেকের মতে বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে আক্ষরিক অনুবাদ যে অসম্ভব—তা তো বলাই বাহুল্য, একই কবিতার তিনজনের করা আলাদা অনুবাদ দেখলেই তা টের পাওয়া যায়। আবার এর চরম বিপরীত উদাহরণ দেখিয়েছেন ইমিটেশা বইতে রবার্ট লোয়েল। সেখানে তিনি বিখ্যাত বিদেশি কবিদের রচনা অনুবাদ করেছেন সম্পূর্ণ নিজের মতন করে, লাইন ভেঙেচুরে, উলটে-পালটে। এমনকী, বোদলেয়ারের কবিতায় পারম্পর্য বোঝবার জন্য দুটি নিজস্ব স্তবক পর্যন্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য, মূলের স্বাদ যখন পাওয়া যাবেই না, তখন অনূদিত কবিতাটি যেন মৌলিক কবিতা হয়ে ওঠে যেকোনও প্রকারে। আমার অনুবাদের পদ্ধতি এইরকম: আমি প্রথমে মূল কবিতা ও ইংরেজি অনুবাদ পাশাপাশি রেখে যতদূর সম্ভব আক্ষরিক অনুবাদ করেছি, তারপর প্রুফ দেখার সময় মূল কবির কথা প্রায় ভুলে গিয়ে, রচনাটি যাতে বাংলায় সুসহ হয় এইজন্য বেপরোয়াভাবে শব্দ কেটেছি এবং বদলেছি। ফলাফল এখনও দুর্বোধ্য। যেসমস্ত কবিদের রচনা বাংলায় আগেও অনূদিত হয়েছে, আমি যতদূর সম্ভব সেই সমস্ত বাঙালি অনুবাদকদের নাম উল্লেখ করে দিয়েছি। এবং বিদেশের কবিতা সম্পর্কে যারা সত্যিকারের উৎসাহী, তাঁরা অবশ্যই শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত সংকলনটি সংগ্রহ করে পড়ে দেখবেন, সেখানে আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিদের করা আরও বহু দেশের বহু সংখ্যক কবিতার অনুবাদ গ্রথিত হয়েছে। আমার এই বইটির যেটুকু আলাদা মূল্য, তা হল, পৃথিবীর প্রধান পাঁচটি ভাষার আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন, মুখ্য চিন্তা, প্রধান কবিদের জীবনী, হৃদয়ের সংবাদ, দুরূহ প্রয়োগের টীকা ইত্যাদি সংক্ষেপে একসঙ্গে উপস্থিত করা হয়েছে। অন্য দেশের কবিতা বুঝতে এগুলি নিশ্চিত সহায়ক। প্রত্যেক ভাষা নিয়ে আলাদা বই বার করলে কাজ আরও সুষ্ঠু সম্পূর্ণ হত। আশা করে রইলুম, অন্য কেউ পরে সে কাজ করবেন।

এই বই পড়ে পাঠকদের যদি কোনও লাভ হয়, খুবই সুখের কথা। আমার অন্তত যথেষ্ট উপকার হয়েছে। প্রায় একবছর ধরে নানান দেশের কবিদের রচনা ও জীবনের সঙ্গে জড়িত থেকে তাদের সঙ্গে কীরকম যেন আত্মীয়তা হয়ে গেছে। এই গ্রন্থের অনেক কবিকে এখন আমার ব্যক্তিগত বন্ধুর মতন মনে হয়।

কবিদের নির্বাচন করার সময় কখনও সমালোচকদের সাহায্য, কখনও ব্যক্তিগত রুচির উপর নির্ভর করেছি। স্প্যানিশ কবিতায় গেব্রিয়েলা মিস্ত্রাল কিংবা জার্মান কবিতায় নেলি শা-এর রচনা আমি গ্রহণ করিনি, কারণ ওঁদের খ্যাতি ও সম্মানের কারণ শুধু সাহিত্য নয়। আবার, ফরাসি কবিতায় সুররিয়ালিজম আন্দোলনের নেতা ও প্রবক্তা আঁদ্রে ব্ৰেততা কিংবা ইতালির ফিউচারিজম আন্দোলনের হোত ফিলিপ্পো মেরিনেত্তি—যাঁদের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন পৃথিবীর সমকালের মহাকবিরা— এঁদের কবিতা যে আমি অন্তর্ভুক্ত করিনি, তার কারণ, সাহিত্যে এঁরা নতুন দর্শনের সৃষ্টি করে গিয়েছেন, কিন্তু কবি হিসেবে কালোত্তীর্ণ হতে পারেননি। সাহিত্য সম্পর্কে তাঁদের ইস্তাহারগুলি ইতিহাসের সামগ্রী হতে পেরেছে, তার থেকে কিছু নমুনা এখানে উদ্ধার করছি।

ফিউচারিস্টিক মেনিফেস্টো

১. বিপদকে ভালোবাসা, বিপদের অভ্যাস এবং হঠকারী দুঃসাহসের গান আমরা গাইতে চাই।
২. আমাদের কবিতার মূল উপাদান হবে, সাহস, অকুতোভয়তা এবং বিদ্রোহ।
৩. চিন্তামগ্ন জড়তা, আনন্দ এবং ঘুম— সাহিত্য এপর্যন্ত এগুলোকেই উদ্ভাসিত করে দেখিয়েছে। এবার আমরা তুলে ধরব, আক্রমণ, আচ্ছন্ন অনিদ্রা, খেলোয়াড়ের পদক্ষেপ, বিপজ্জনক লাফ, কানমলা এবং ঘুষোঘুষি।
৪. আমরা ঘঘাষণা করছি যে পৃথিবীর বিস্ময় সম্প্রতি ধনী হয়েছে এক নতুন সৌন্দর্যে: গতির সৌন্দর্য। কামানের গোলার মধ্যে দিয়ে ছুটে যাওয়া একটি গর্জমান মোটরগাড়ি ভিকট্রি অব সামোথরেসের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।
৫. স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে যে মানুষ তার গান গাইতে চাই— যার আদর্শ দণ্ড ভেদ করে যাচ্ছে পৃথিবী, যে তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘূর্ণ্যমান।
৬. বিলাসী অপব্যয়, উজ্জ্বলতা ও তাপে কবি নিজেকে নিঃশেষ করতে বাধ্য–যাতে আদিম উপাদানগুলির জ্যোতি উজ্জীবিত হয়।
৭. যুদ্ধ ছাড়া আর কোথাও কোনও সৌন্দর্য নেই। আক্রমণকারীর চরিত্র ছাড়া কোনও মহৎ সৃষ্টি সম্ভব নয়। কবিতাকে হতে হবে অজ্ঞাত শক্তির বিরুদ্ধে হিংস্র আঘাত যাতে তারা মানুষের পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ে।
৮. আমরা সমস্ত শতাব্দীর দুর উপকূলে দাড়িয়ে আছি। আমাদের তো কাজ অসম্ভবের রহস্যময় দ্বার ভেঙে ফেলা, সুতরাং পেছনে তাকিয়ে কী লাভ? টাইম এবং স্পেস গতকাল মারা গেছে। আমরা এখনই বেঁচে আছি অনন্তের মধ্যে, কারণ আমরা ইতিমধ্যে সৃষ্টি করেছি শাশ্বতের সদা জাগ্রত গতি।।
৯. আমরা গৌরবময় করতে চাই যুদ্ধ–যুদ্ধেই পৃথিবীর একমাত্র স্বাস্থ্য ভালো থাকে— সামরিক শাসন, দেশাত্মবোধ, সন্ত্রাসবাদীর ধ্বংসচেষ্টা, হত্যার মহৎ আদর্শ, নারীর ঘৃণা।
১০. মিউজিয়াম, লাইব্রেরিগুলো ধ্বংস করব আমরা, যুদ্ধ করতে হবে নীতিবাদ, নারীর স্বাতন্ত্র্য আর সব সুবিধাবাদী, উপকারবাদী কাপুরুষতার বিরুদ্ধে ইত্যাদি।

.
ফিলিপ্পো মেরিনেত্তির এই ইস্তাহারের অনেকখানিই এখন ছেলেমানুষি মনে হতে পারে। কিন্তু এর সারবস্তু, পুরনো বিশ্বাসের প্রতি উচ্চারিত বিদ্রোহ ও ভাঙনের আহ্বান অন্যান্য প্রতিভাবান কবিদের প্রেরণা দিয়েছিল একসময়। এই ছেলেমানুষির বশেই মেরিনেত্তি কবিতার আঙ্গিকে যেসব উদ্ভট ভাঙাচোরা ও রীতিবদলের চেষ্টা করেছিলেন, তাতে তার নিজের কবিতা সার্থক হয়নি কিন্তু অপর কবিদের নতুন রীতি প্রণয়নে সাহায্য করেছে। মেরিনেত্তি নিজের কাছেও পরাজিত হয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত, এতসব বিদ্রোহের কথার পরও–তিনি স্বয়ং যোগ দিয়েছিলেন মুসসালিনির ফ্যাসিস্ত দলে, প্রচুর খেতাব ও সরকারি সম্মান পেয়ে ব্যর্থসুখে কাটিয়েছেন বৃদ্ধ বয়েস। ফিউচারিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রথম ছাপা হয়েছিল প্যারিসে, ১৯০৯ সালে।

আঁদ্রে ভেঁতোর সুররিয়ালিস্ট মেনিফেস্টো–প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯২৪-এ, তারপর তিনি আবার লিখেছিলেন দ্বিতীয় মেনিফেস্টো, দীর্ঘদিন পরে তিনি আবার সমগ্রভাবে সুরারিয়ালিজমের মুখ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লেখেন। সে দীর্ঘ রচনার অনুবাদ এখানে সম্ভব নয়, তবে তার সারমর্ম আমি বিভিন্ন সুররিয়ালিস্ট কবিদের সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি।। ঘোট ঘোট শাখা আন্দোলনগুলির প্রতিভূ হিসেবে আমি একজন বা দুজনকে বেছে নিয়েছি; কিন্তু সব সময় তারাই যে সে দলের শ্রেষ্ঠ কবি এমন নয়। যাঁদের কবিতা অনুবাদে কিছুই বোঝা যায় না, তাদের বাদ দিয়ে আমার পক্ষে সুবিধাজনকদেরই নির্বাচন করেছি। যেমন জার্মানিতে অগুস্ট স্ট্রাম একজন প্রধান কবি, কিন্তু তার কবিতা অনুবাদে প্রায় অর্থহীন দাড়ায়, এইরকম:

যুদ্ধক্ষেত্র

উৎপন্ন কাদা ফিসফিসিয়ে লোহাকে ঘুম পাড়ায়
রক্ত চাপ বাঁধে সেখান থেকে তারা গড়াচ্ছিল
মরচে গুঁড়োয়
মাংস থিক থিক
লোভ চোষে ক্ষয়ের চারপাশে
হত্যার ওপর হত্যা
চোখ মারে ছেলেমানুষি চোখে।

অনেক কবির দীর্ঘ কবিতা সম্পূর্ণ অনুবাদ করতে পারিনি, কারণ আমি ধৈর্যহীন। তবে, তথ্য, তারিখে যাতে ভুল না থাকে সে সম্পর্কে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। তা সত্ত্বেও যদি কোনও ত্রুটি কারুর চোখে পড়ে সে সম্পর্কে আমাকে উপদেশ বা পরামর্শ জানালে কৃতার্থ চিত্তে গ্রহণ করব। অকপটে স্বীকার করি, নিজের অযোগ্যতা সম্পর্কে আমার কোনও ভুল ধারণা নেই এবং সত্যিই খুব সংকোচের সঙ্গে এই বইটি প্রকাশ করছি।

নানা সময়ে আমাকে বই দিয়ে সাহায্য করেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, শরকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, উৎপলকুমার বসু, জ্যোর্তিময় দত্ত, বেলাল চৌধুরী, শুদ্ধশীল বসু। তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 102

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts